জীবনের এত বছর পেড়িয়ে গেলেও কখনো বিয়ে করেননি। সারা জীবন একা কাটিয়ে দিয়েছেন শিক্ষিকা উর্মিলা ভট্টাচার্য। অবসরের পর জীবনের শেষ সঞ্চয় পেনশনের প্রায় ৩০ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন ভাই-বোনদের হাতে।
আশা করেছিলেন, জীবনের শেষ সময়টা ভাই-বোনেরা তাকে দেখে রাখবেন। কিন্তু হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় তাদের কাউকে পেলেন না। শেষকৃত্যে রইলেন শুধু দূরসম্পর্কের আত্মীয় আর প্রতিবেশীরা।
শিক্ষিকা উর্মিলা ভট্টাচার্য উপজেলার ছনহরা ইউনিয়নের মটপাড়া এলাকার মৃত বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্যের মেয়ে। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর গত সোমবার (২৩ জানুয়ারি) পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মারা যান উর্মিলা ভট্টাচার্য।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্যের ২ ছেলে, ৯ মেয়ের মধ্যে উর্মিলা ভট্টাচার্য ছিলেন পরিবারের ৬ নম্বর মেয়ে। ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষিকা। পরিবার থেকে অনেকবার চাপ দেয়ার পরও বিয়ে করেননি তিনি। ২০১৪ সালের দিকে চাকরি থেকে অবসরে যান তিনি। সবশেষ শিক্ষকতা করেছেন চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শিশু নিকেতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
পরবর্তীতে শহরের বাসায় শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন তিনি। এছাড়া অবসর সময়ে পেয়েছেন পেনশনের এককালীন প্রায় ৩০ লাখ টাকা। স্বামী-সন্তান কেউ না থাকায় পেনশনের টাকা ছোট ভাই অমর কৃষ্ণ ভট্টাচার্যসহ অন্যান্য ভাই-বোনদের হাতে তুলে দেন। উর্মিলা ভট্টাচার্যের আশা ছিল, শেষ বয়সে তার ভাই, বোন, ভাতিজারা পাশে থাকবেন।কিন্তু শেষ সময়ে কাউকে পাননি ৭০ বছর বয়সী ওই নারী। পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিছানায় ২২ দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে সোমবার রাত ১২টার দিকে পটিয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
মৃত্যুর আগে সর্বশেষ গত সোমবার বিকেলে অসুস্থ উর্মিলা ভট্টাচার্য জানান, ‘তিনি আগ্রাবাদ শিশু নিকেতনে শিক্ষকতা করতেন। অবসরকালীন প্রায় ৩০ লাখ টাকা এককালীন পেনশন পেয়েছেন, যা তিনি তার ভাই-বোনদের দিয়েছেন। ওই টাকায় তারা পুকুর খনন করেছেন, জমি কিনেছেন। কিন্তু তিনি তা ভোগ করছেন না। কয়েক দিন আগে তার এক বোনের ছেলে হাসপাতালে এসেছিলেন। তাকে ২ হাজার টাকা দিয়ে চলে গেছেন। ভাই-বোনেরা কেউ খবর নিচ্ছে না বলে জানিয়েছিলেন তিনি।’ পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ২ জানুয়ারি উর্মিলা ভট্টাচার্য পেটব্যথা নিয়ে ভর্তি হন পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এরপর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে ১৫ জানুয়ারি তাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়, কিন্তু হাসপাতাল ছেড়ে যাননি তিনি। এরপর তার কোনো স্বজন হাসপাতালে না আসায় বিপাকে পড়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ফারহানা জেরিন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান,‘বৃদ্ধা হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই কোনো স্বজন হাসপাতালে আসেননি। আমরা সরকারিভাবে সব ওষুধসহ চিকিৎসাসেবা দিয়েছি। তাকে ছাড়পত্র দেয়ার পরও তিনি হাসপাতালের বেড ছাড়েননি। একসময় তার অবস্থা দিন দিন অবনতি যখন হচ্ছিল, বেড ছেড়ে কোথাও নিজে যেতে পারছেন না। আমরা রোগীর ছোট ভাই অমর কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছি। তিনি ঢাকায় আছেন জানিয়ে বলেন-আমার কিছুই করার নেই।’
তিনি আরো জানান,‘এরপর আমরা পটিয়া গাউছিয়া কমিটিকে খবর দিই। তাদের টিম ও হাসপাতালের নার্সদের সমন্বয়ে ওই রোগীর সেবাযত্ন করছিলেন। সোমবার রাতে তার মৃত্যুর খবরটা জানানো হয়েছে তার ভাইপোকে। তিনি দূরে আছেন বলে জানিয়েছেন। মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তার দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের কাছে লাশটি হস্তান্তর করা হয়েছে।’ ছনহরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ দৌলতী বলেন, ‘শিক্ষিকা উর্মিলা ভট্টাচার্য আমার এলাকার বাসিন্দা। সারা জীবন চিরকুমারী ছিলেন। তার ভাইয়েরা সবাই বড়লোক হওয়ার পরও তাকে দেখতেন না। তার মৃত্যুর পরও তারা লাশটি গ্রামের বাড়িতে দাহ করতে বাধা দেন। কিন্তু আমি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার নিজ উদ্যোগে লাশটির দাহ করার কাজ সম্পন্ন করেছি।’